জয় বা পরাজয়, দরকার তৃতীয়বারে প্রার্থী ও তার পরিবারের কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহন নিষিদ্ধ আইন; দেশের স্বার্থেই অনুসরণ করা উচিত উন্নত বিশ্বের সরকার প্রণয়ন ব্যবস্থা।
একটি ভালো ব্যাংক ধ্বংসমূখীতার জ্বলন্ত উদাহরণ ইসলামী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। যার প্রকৃত আকার ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি বলে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা। ছাগলকাণ্ডের মতি যেমন বাংলাদেশের রাজস্ব বিভাগ নয় তেমন দু-চারজন সালমান এফ রহমান বা এস আলমই বাংলাদেশের অর্থনীতি নয়। জনাকয়েক বেনজীর, হাবিবুর, হারুনুরও বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী নয়। একজন আজিজও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নয়। কিছু সময়ের নোংরা রাজনীতির গুটি বা ঘুঁটি তারা।
এরা শুধু গোটা দেশেরই সর্বনাশ করেনি, ধর্ষণ করেছে দেশের সার্বভৌমত্বকে। তাদের অপকর্মে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের ইমেজের ক্ষতি হয়েছে সত্য। তাই বলে বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে, বাংলাদেশ আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না; এমনটি মোটেই মনে করার নয়। একইভাবে সালমান এফ রহমানের ধরা পড়া, বেনজীর-মতিউরদের চম্পটে দেশের অর্থনীতি ঘুরে যাবে, তাও কিন্তু সম্ভব নয়। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী হিসেবে বহুল সমালোচিত ব্যবসায়ী এস আলম ও তার পরিবারের সব সদস্যের ব্যাংক হিসাব তলবে সব ঠিক হয়ে গেছে, সেটি ভাবারও অবকাশ নেই।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির আনুকূল্যে থাকা ব্যক্তিদের অর্থ লোপাটের তথ্য একে একে বেরিয়ে আসছে। বিশেষ করে ব্যাংক খাতের ঘা একদম দগদগে। গত ১৫ বছরে বড় ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে কেবল এস আলম গ্রুপ ও বেক্সিমকো গ্রুপের সালমান এফ রহমান ব্যাংক খাত থেকে নিয়েছে ৮৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এমনটা হতোনা যদি আইন হতো, জয়-পরাজয় যাই হোক, দ্বিতীয়বারের পরে কোন ব্যক্তি ও তার পরিবারের কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না।
শুরুতেই বলেছি, একটি মানসম্পন্ন ব্যাংকে ধ্বংসের মুখে পরার জ্বলন্ত উদাহরণ ইসলামী ব্যাংক। ২০১৭ সালে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে জামায়াতমুক্ত করার উদ্যোগ হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর সাড়ে সাত বছরে নামে-বেনামে ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ ও এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ। এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সাত ব্যাংকে ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। যার প্রকৃত আকার ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
গত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি হরিলুটের শিকার হয়েছে আমাদের দেশের ব্যাংক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য দেখলাম, মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। যেখানে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা ছিল। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বেড়েছে।
এমতবস্থায় নতুন সরকারের একটি বড় দায়িত্ব ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যে কোনো মূল্যে খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যার মধ্যে অন্যতম হিসাবে ঋণখেলাপিদের পরিবার ও কর্ম সংশ্লিষ্টদের সকল ধরণের ব্যাংকিং সুবিধা স্থগিত করার পাশাপাশি তাদের দেশ-ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা। এক্ষেত্রে তাদের সকল স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পদসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থায়ী বা অস্থায়ী ভাবে অধিগ্রহণের মাধ্যমে ঋণের সিংহভাগই পুনরুদ্ধার হতে পারে সম্ভবনাময়।
ব্যাংক খাত থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণের প্রবণতা রোধে এবং পুঁজিবাজারকে আরও গতিশীল করতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মূখ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা উচিত। পুনরুদ্ধার প্রশ্নে আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা, অর্থনীতি সামাজিক খাত, শিক্ষা কোনটির চেয়ে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ এক কথায় তা বলাও সম্ভব নয়। এগুলোর প্রতিটিই অগ্রাধিকারের বিষয়।
রাজস্ব আহরণের অপর্যাপ্ততা, সরকারি ব্যয় সংকুলানে ব্যর্থতা, এডিপি বাস্তবায়নে শ্লথগতি, ব্যাংক খাত থেকে সরকারের উচ্চমাত্রায় ঋণ দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে চেপে ধরেছে, তা থেকে কেউ মুক্ত নন।দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট, রপ্তানি আয়ে ধীরগতি, রেমিট্যান্স প্রবাহে মন্থরতা, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতার মতো সমস্যাগুলোতে কোনো না কোনোভাবে দেশের প্রতিটি মানুষ আক্রান্ত।
অর্থনীতির গতি আনতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবক্ষয়, আমদানিতে ক্রমহ্রাসমান প্রবণতা, টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমস্যাগুলো সমাধান সবার জন্যই জরুরি। সামাজিক খাত পুণর্গঠনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্বাভাবিক করা, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, শ্রমবাজারের চাহিদা ও দক্ষতার অসামঞ্জস্যতা দূর করা কার জন্য প্রযোজ্য নয়…?
ঘুষ ও দুর্নীতির কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসা, অভিজ্ঞতার অযৌক্তিক প্রয়োজনীয়তা, সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে যুবকদের বড় একটা অংশ বৈষম্যের শিকার। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মূল থিমও এটি বটে। ১৯৭১-এ স্বাধীনতার অন্যতম আকাঙ্ক্ষাও ছিল এই শ্রেণিবৈষম্যের অবসান।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বছর কয়েক থেকেই দেশের অর্থনীতির ভঙ্গুর দশা। ঋণখেলাপিতে বিপর্যস্ত ব্যাংক খাত, ডলার-সংকটে রিজার্ভ কমতে কমতে তলানিতে, পাহাড়সম বিদেশি ঋণ, রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ভাটার টান, গতিহীন রাজস্ব আয়, জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক দামে মূল্যস্ফীতিও হয়েছে লাগামহীন। ছাত্র-জনতার আকস্মিক গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামল শেষে এমনই ফোকলা অর্থনীতি সামলানোর ভার এসে পড়েছে সদ্য দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন ড. ইউনূস সরকারের ওপর। এ দায়িত্ব তিনি উতরানোর পদক্ষেপও নিয়েছেন।
অর্থনীতিকে ঠিক জায়গায় আনতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে হবে। নইলে অর্থনীতিতে আরও করুণ রূপ ধারণ করার ব্যতিক্রম হবে না। উদ্যোক্তারাও তড়িঘড়ি না করে নতুন সরকারকে সময় দেওয়ার পক্ষে। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে লুকোচুরি থাকলেও তা শুদ্ধ করার চেয়ে এখন দরকার দ্রুত পদক্ষেপ।
ডলার বাড়ানোর বড় খাত রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে বেশ কিছুদিন ধরেই ভাটার টান চলছে। সেখানে যদ্দূর সম্ভব ভাটা কাটিয়ে জোয়ার আনতেই হবে। রেমিট্যান্স কমে গেছে বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। পোশাক খাতে কত ক্ষতি হয়েছে সেই হিসাব বের করার চেয়ে তা কাটানোর পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি। অর্ডার কমে গেছে বলে কমতেই থাকবে, তা কল্পনা করাও নিছক নির্বুদ্ধিতা।
পতনের পর বেখবর হয়ে যাওয়া সরকারের ওপর দেশের সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ ছিল জিনিসপত্রের লাগামহীন দামের বিষয়টি। বছরজুড়ে প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ অনেকটাই পিষ্ট। এমন অবস্থায় মানুষের চাওয়া পণ্যের দাম নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা। কয়েক বছর ধরে অর্থনীতির গতিহীনতার জন্য সরকারের রাজস্ব আদায়েও গতি ছিল না। ফলে প্রতি বছরই উচ্চ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বড় ঘাটতি পড়ে।
সর্বশেষ বিদায়ী অর্থবছরেও কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি আগের সরকার। ফলে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি পড়ে প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিতে যেভাবে সংকট বাড়ছে, সে সময়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয় বাড়াতে না পারলে অবশিষ্টও সর্বনাশ হবে। দায়দেনার পরিমাণ আরও বাড়বে। তখন নতুন সরকারকেও দেশ পরিচালনা ও বাজেট বাস্তবায়নের জন্য দেশি-বিদেশি উৎসের কাছে হাত পাততে বাধ্য হবে।
আর্থিক খাতে বর্তমান বিশৃঙ্খলার জন্য যাদের সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়, তাদের অন্যতম পলাতক সাবেক গভর্নর ও অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। শেখ হাসিনা সরকারের টানা তিন মেয়াদেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর থেকে অর্থ সচিব হয়ে চলতি বছর ৯ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থব্যবস্থার মৌলিক নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। এ কারণেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন আব্দুর রউফ তালুকদার আজ পলাতক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র গভর্নর, যিনি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিজেই পাচার বা নিরুদ্দেশ হয়েছেন।
দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা পুনরায় দেশে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসবিরোধী অর্থায়ন প্রতিরোধ-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কাউন্সিলকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে পাচারকারীদের সম্ভাব্য তালিকা করার নির্দেশনা দিয়েছেন ঠিকই; যার ভবিষ্যৎ হয়তো ঐ কাগজের নাম তালিকা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
অন্যথায়, রাজনৈতিক পালাবদলের এ প্রেক্ষাপটে কেউ যাতে অর্থ তুলে নিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে, তা প্রতিরোধে সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাব জব্দ, বিধি অনুযায়ী সম্পদের হিসাব এবং পরিবারে অন্যান্যদের আয়ের উৎস ও সম্পদ। পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারের ফাঁকফোকরসহ হুন্ডি প্রতিরোধে করণীয় বিষয়েও আলোচনা প্রেক্ষাপটে অর্থ উদ্ধার বা ফেরত আনা না গেলেও পাচারকারীদের অন্তত দৌড়ের ওপর তো রাখা সম্ভব।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে ব্যাপক প্রাণহানি ছাড়াও দেশের অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। তাই এ মুহূর্তে সর্বাধিক বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কীভাবে দ্রুত কমিয়ে আনা যায়, তার ব্যবস্থা করা। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় সাধারণ মানুষ চরম বিপর্যয় সইছে।
এহেন পরিস্থিতি দূরীকরণের উদ্যোগ নেয়ার পাশা পাশি এখন শৃঙ্খলা সংস্থাসহ উপোরযুক্ত বিষয়বস্তু বাস্তবায়নে দেশে প্রয়োজন প্রচুর মানব শক্তি। আজকে পর্যন্ত দেশে বেকার রয়েছে প্রায় দেরকোটি, এর এক-চতুর্থাংশকেউ যদি মেধাঅনুযায়ী নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে একদিকে যেমন দেশ গঠনের হাত হবে প্রখর ও শক্তিশালী অপর দিকে দেশ থেকে নিপাত যাবে বেকারত্ত্ব নামের পঙ্গুত্ব।
বিকার রাজনীতি নয়, সমৃদ্ধ অর্থনীতিতে হাতিয়ার হউক আজ ও আগামীর যুব-সমাজ।