ছাত্রলীগের অলিখিত হেডকোয়ার্টার মধুর ক্যান্টিন এখন কেবলই একটি ক্যান্টিন; সাধারনের আশা-ভরসার স্থান হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জুনের ৫ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন জুন মাসে ক্যাম্পাসের ভেতর থাকলেও, ঈদের ছুটির পর জুলাই মাসের ২ তারিখ চলে আসে শাহবাগে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এর পরের গল্পগুলো যে কোনো রূপকথাকেও হার মানায়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণঅভ্যুত্থানের পর এখনও আগের আমেজ ফেরেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে। আগে চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীর ভিড়ে পূর্ণ থাকত এ গ্রন্থাগার। গণঅভ্যুত্থানের পর লাইব্রেরি খুললেও সেভাবে আর ভিড় চোখে পড়ছে না।
শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পরও বছরের পর বছর হলের সিট দখল করে থাকা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা হলে আর নেই। গণরুম, পলিটিক্যাল রুমের বিলুপ্তি ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলপাড়ায় এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস। প্রতিটি হলে প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর ও একাধিক হাউস টিউটর থাকলেও, হলগুলো মূলত ছাত্রলীগই পরিচালনা করত। প্রতিটি সাধারণ শিক্ষার্থীর বৈধ সিট পাওয়ার অধিকার থাকলেও, ফার্স্ট ইয়ার থেকে হলে থাকতে হলে উঠতে হতো ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত গণরুমে।
গণরুমে ওঠার পর অবধারিতভাবেই নিয়মিত যোগ দিতে হতো ছাত্রলীগের সভা-সমাবেশ ও নানা কর্মসূচিতে। শিক্ষার্থীদের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রয়োগ ও বহাল রাখতে চালু ছিল ‘গেস্ট রুম’ নামক বিভীষিকাময় টর্চার সেল। গণঅভ্যুত্থানের পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলে ফিরলেও ফিরে আসেননি তাদের ‘স্বঘোষিত অভিভাবক’ ছাত্রলীগ নেতারা। বিজয় একাত্তর হলের যমুনা ব্লকের গেমস রুমকে বানানো হয়েছিল গণরুম।
এখন সেখানে কোনো ছাত্র থাকছে না। অন্যান্য হলের গণরুমগুলোয় চৌকি বসানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বৈধ সিট নিশ্চিত করছে হল প্রশাসন। অ্যালটমেন্টের ভিত্তিতে একসময়কার প্রতাপশালী ছাত্রনেতাদের রুমেও থাকতে শুরু করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন হলের সামনে ‘রাজনীতিমুক্ত হল’ লিখে ব্যানার টানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
হলের ক্যান্টিনগুলোয় খাবারের দাম ৮-১০ টাকা কমলেও, খাবারের মান খুব একটা বাড়েনি। আগে হল ক্যান্টিনগুলোয় ছাত্রলীগ নেতাদের চাঁদাবাজির জন্য খাবারের মান নিশ্চিত করতে পারতেন না ক্যান্টিন মালিকরা। এখন চাঁদাবাজি নেই, শিক্ষার্থীরা আশা করছেন দ্রুত খাবারের মানও বাড়বে।
জুলাই অভ্যুত্থানের বড় অংশজুড়েই ছিল নারী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ। আন্দোলনের শুরুর দিকে নারী শিক্ষার্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে অংশগ্রহণ করলেও, কিছুদিনের মধ্যেই রূপ পাল্টে যায়। হল গেটে ঘণ্টা পিটিয়ে জমায়েত হওয়া শুরু করেন মেয়েরা। ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলার প্রতিবাদে মধ্যরাতে রোকেয়া হলের ছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ ও রাস্তায় নেমে আসা জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম দিকনির্ধারক ঘটনা।
গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্রীরা হলে ফিরতে শুরু করেছেন। ছাত্রীদের কোনো কোনো হলের ‘পলিটিক্যাল রুমগুলো’ এখনও ফাঁকা। কিছু রুমে সাধারণ শিক্ষার্থীরা উঠেছেন। ছাত্রলীগ নেত্রীরা ফিরে না এলেও, যেসব ছাত্রলীগ নেত্রী বৈধ সিটে থাকতেন তাদের কেউ কেউ হলে ফিরে আসছেন। তবে সব হলের রিডিং রুমগুলো এখনও শূন্য পড়ে আছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের সাধারণ মানুষের আশা ও ভরসার স্থান হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষত টিএসসি। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বন্যা এবং এর ফলে সৃষ্ট মানবিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গণত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় গত ২১ আগস্ট। গত কয়েকদিনে টিএসসির বুথে জমা পড়েছে সাত কোটি টাকার অধিক; জমা হয়েছে পাহাড়সম ত্রাণের স্তূপ।
ত্রাণের স্তূপে টিএসসির মাঠ ও আশপাশ ভরে যাওয়ায় খুলে দেওয়া হয়েছে জিমনেশিয়ামের গেট। ত্রাণ প্যাকেজিং ও সংগ্রহের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। পায়রা চত্বরে এখন অন্য যে কোনো সময় থেকে ভিড় বেশি। সন্ধ্যার আগ থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে এখন চায়ের কাপে চুমুকের সঙ্গে চলতে থাকে আড্ডা।
গণঅভ্যুত্থানের আগে রাজনৈতিক কথাবার্তা বলতে হতো খুব হিসাব করে, সতর্ক থেকে। এখন টিএসসিতে বসেই শিক্ষার্থীরা নানা পরিকল্পনা করছেন, ছক কষছেন।
ছাত্রলীগের অলিখিত হেডকোয়ার্টার মধুর ক্যান্টিন এখন কেবলই একটি ক্যান্টিন। আগে সময়ে-অসময়ে নিজের ক্ষমতা জাহিরের জন্য দলীয় কর্মীদের নিয়ে মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান নিতেন ছাত্রলীগ নেতারা।
নেতা মধুতে যাবেন–এমন খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে পড়িমরি করে হল থেকে বের হয়ে নেতার প্রটোকল নিশ্চিত করতে হতো শিক্ষার্থীদের। দিনের বড় অংশজুড়ে মধুর ক্যান্টিন দখলে রাখত ছাত্রলীগ। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাই এ ক্যান্টিন এড়িয়ে চলতেন। আন্দোলন চলাকালে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান নিয়েছিল ছাত্রলীগের হাইকমান্ড।
গণঅভ্যুত্থানের পর মধুর ক্যান্টিনে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। নেই কোনো দলীয় কর্মী, শোনা যাচ্ছে না কোনো স্লোগান। তবে মধুর ক্যান্টিনের খাবারের মান আর চড়ামূল্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভেতর অসন্তোষ বিরাজমান।
সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য এতদিন ছিল সন্ত্রাসীদের দখলে। সর্বশেষ আন্দোলন চলাকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন শাহবাগে অবস্থান করছিলেন, তখন রাজুতে পাল্টা সমাবেশ ডেকেছিল ছাত্রলীগ। হল থেকে জোরপূর্বক সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রায়ই রাজুতে নিয়ে আসা হতো ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে। তীব্র রোদে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তেন শিক্ষার্থীরা। রাজু এখন সত্যিই সন্ত্রাসমুক্ত।
বিপ্লবের রং লেগে আছে ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে। ক্যালেন্ডারের পাতায় যদিও আগস্ট শেষ হওয়ার পথে, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনও থেমে আছে জুলাই মাসে। যে জুলাই হয়তো কোনোদিন শেষ হবে না।