ইতোমধ্যেই পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসাবে সফর রাজ চৌধুরীর নাম ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর পর থেকেই পুলিশের সংস্কারে ফের শুরু হয়েছে তৎপরতা।
দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন দল পুলিশ বাহিনীকে জনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গুলি করে মানুষ হত্যা এই বাহিনীর ভাবমূর্তি একবারে তলানিতে নিয়ে গেছে। পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা আত্মগোপনে গেছে। এমন প্রেক্ষাপটে দাবি উঠেছে পুলিশ সংস্কারের।
ইতোমধ্যেই পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসাবে সফর রাজ চৌধুরীর নাম ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর পর থেকেই পুলিশের সংস্কারে ফের শুরু হয়েছে তৎপরতা। ইতোমধ্যেই জাপানের আদলে এ সংক্রান্ত একটি সংস্কার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে। পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটের একটি টিম ওই প্রস্তাবটি পাঠিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র সংবাদ মাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছে।
কমিশনের কার্যাবলির বিষয়ে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পুলিশপ্রধান হিসাবে নিয়োগের জন্য অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার তিনজন কর্মকর্তার একটি প্যানেল সরকারের কাছে পাঠাবে কমিশন। সেখান থেকেই একজনের নিয়োগ চূড়ান্ত করবে সরকার। পুলিশপ্রধানসহ অন্য কর্মকর্তাদের বদলির সুপারিশ করতে পারবে জাতীয় পুলিশ কমিশন। পাশাপাশি পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের কার্যক্রম তদারকি করবে কমিশন। প্রতিবছর আগস্ট মাসের মধ্যে প্রত্যেক পুলিশ ইউনিট থেকে তাদের কার্যক্রম উল্লেখ করে একটি সাধারণ প্রতিবেদন কমিশনে পাঠাতে হবে। কমিশনের পক্ষ থেকেও বার্ষিক প্রতিবেদন সরকার এবং সংসদের কাছে পেশ করা হবে। পুলিশের দায়িত্বের বিষয়ে বলা হয়েছে, জনগণকে যথাযথ সম্মান দিতে হবে। তাদের সঙ্গে সৌজন্যতা দেখাতে হবে। দরিদ্র, অক্ষম, দুর্বল ও বৃদ্ধদের নিরাপত্তাবোধ এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশি ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করতে হবে।
যুগ যুগ ধরে ঔপনিবেশিক আইনে চলছে পুলিশ। অবৈধ প্রভাবের মাধ্যমে পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের ভেতর এবং বাইরের ক্ষোভ অনেকটা প্রকাশ্য। অনেক আগেই দাবি উঠেছে পুলিশ সংস্কারের। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় এ দাবি জোরালো হয়েছিল। তখন প্রস্তাব আসে, নতুন পুলিশ আইন প্রণয়নের। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ, ২০০৭-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়। খসড়াটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আটকে যায়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেটি চলে যায় ‘ডিপ ফ্রিজে’। টানা সাড়ে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে গত সরকার পুলিশকে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করেছে। এই অবস্থায় পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি সময়ের দাবি।
পুলিশ সংস্কারে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পুলিশ চলবে ন্যাশনাল পাবলিক সেফটি কমিশনের অধীনে। এই কমিশনের অধীনে থাকতে পারে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য দপ্তরও। পাবলিক সেফটি কমিশনের অধীনে থাকলেও পুলিশের জন্য থাকবে জাতীয় পুলিশ কমিশন। প্রধানমন্ত্রী কখনো এই কমিশনের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। কমিশন হবে রাজনৈতিক ও দলীয় প্রভাবমুক্ত। আরও বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী পদাধিকারবলে ১১ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিশনের চেয়ারপারসন হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। জাতীয় সংসদের স্পিকার, সংসদ নেতা এবং বিরোধীদলীয় নেতার পরামর্শ অনুযায়ী কমিশন চারজন সংসদ সদস্য মনোনীত করবেন। তাদের মধ্যে দুজন সরকারি দলের এবং দুজন বিরোধী দলের হবেন। জাতীয় সিলেকশন প্যানেলের মাধ্যমে সুপারিশকৃত ছয়জনের তালিকা থেকে চারজন সদস্য মনোনীত হবেন। এই চারজনের মধ্য থেকে একজন নারী এবং একজন জনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা থাকবেন। এছাড়া স্বরাষ্ট্র সচিব এবং পুলিশপ্রধান পাদাধিকারবলে কমিশনের সদস্য হবেন। কমিশনের সদস্য সচিব হিসাবে কাজ করবেন পুলিশপ্রধান।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়, পুলিশ সদস্যের আচরণের মানোন্নয়নের জন্য পুলিশপ্রধান ‘আচরণবিধি’ জারি করবেন। পুলিশ সদস্যদের অপরাধের বিচারের জন্য পুলিশ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সংস্কার প্রস্তাবে। বলা হয়েছে, সিনিয়র র্যাংকের পুলিশ সদস্যদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রধান থাকবেন একজন অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার কর্মকর্তা। আর জুনিয়র র্যাংকের কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রধান হবেন পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। এএসপি থেকে আইজিপি পর্যন্ত পদমর্যাদার কর্মকর্তারা সিনিয়র র্যাংক এবং কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা জুনিয়র র্যাংক হিসাবে বিবেচিত হবেন। জাতীয় প্রশিক্ষণনীতির আলোকে সব র্যাংক ও পদের পুলিশ সদস্যের জন্য একটি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নীতি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবে। আরও বলা হয়েছে-পুলিশপ্রধান, ইউনিটপ্রধান ও জেলা পুলিশপ্রধান তাদের অধিক্ষেত্রে নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, অস্ত্রশস্ত্র, ব্যায়াম, শৃঙ্খলা, পোশাক-পরিচ্ছদ, কর্মবণ্টন, নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশ সদস্যদের কর্তব্য সম্পাদনসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ন্ত্রণ করবেন। পুলিশের জন্য একটি গবেষণা ব্যুরো তৈরির কথাও বলা হয়েছে।
জানা যায়, সম্প্রতি পুলিশের পক্ষ থেকে যে সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সে ধরনের প্রস্তাব ২০০৭ সালেও দেওয়া হয়েছিল। ২০০৭ সালের প্রস্তাবে একটি নতুন পুলিশ আইন তৈরির কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, পুলিশি কর্মকাণ্ডে অবৈধ হস্তক্ষেপকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করতে হবে। পুলিশের কার্যক্রমে শক্তিপ্রয়োগ ন্যূনতম থাকবে। আইন প্রয়োগের নামে বেআইনি উপায়ের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত- উভয়ের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ২০০৭ সালের পুলিশ অধ্যাদেশ খসড়ায় পুলিশপ্রধান নিয়োগে তিন সদস্যের সংক্ষিপ্ত তালিকা অনুসরণ এবং বিভিন্ন ইউনিটপ্রধানের মেয়াদকাল অনধিক তিন বছরের কথা উল্লেখ করা হয়। এছাড়া পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা পলিসি, সাময়িক বরখাস্ত, পুলিশপ্রধান ও ইউনিটপ্রধানদের ক্ষমতা, নতুন ইউনিট গঠন, উন্নয়ন পরিকল্পনা, বিশেষ নিরাপত্তা এলাকা গঠন, পুলিশ গবেষণা ব্যুরো প্রতিষ্ঠা, পুলিশ অভিযোগ কর্তৃপক্ষ গঠন, আচরণবিধি, পুলিশ ট্রাইব্যুনাল, পুলিশের কল্যাণ, পুলিশ পলিসি গ্রুপ প্রতিষ্ঠা, জনসমাবেশ-শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণ, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা সংরক্ষণ, অপরাধ ও শাস্তি, থানা পুলিশের কার্যক্রম ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছিল ওই খসড়ায়।
এ বিষয়ে পুলিশ সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান সফর রাজ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, পুলিশে সংস্কারের জন্য কেবল কমিশনের প্রধান হিসাবে আমার নিয়োগ হয়েছে। এখনো অন্য সদস্যদের নাম চূড়ান্ত হয়নি। সবচেয়ে বড় বিষয়, এখনো কমিশনের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনগুলো পাইনি। কত সদস্যবিশিষ্ট কমিশন হবে সেটাও ঠিক হয়নি। আশা করছি দ্রুতই এগুলো হয়ে যাবে। ১ অক্টোবর থেকে কমিশনের অফিসিয়াল কার্যক্রম শুরু হবে।