ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সংসারের উন্নত জীবনের আশা নিমিষেই ভঙ্গ হয়ে গেল। অর্ধেক ঋণও পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে নিভে গেল প্রবাসীর জীবন প্রদীপ
বাড়ির উঠানে দুইদিন ফ্রিজার ভ্যানের ভেতরে পড়েছিল ওয়াজ উদ্দিন নামে এক মালয়েশিয়া প্রবাসীর মরদেহ। দাফন হয়নি কেন? জানতে চাইলে মৃত ওয়াজ উদ্দীনের স্ত্রী শিউলী বেগম জানান, স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিষয়টি মিমাংসা করে তারপর দাফনের কথা রয়েছে। তাই দাফন করা হয়নি।
মৃত ওয়াজ উদ্দিনের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার উত্তর মীর্জানগর গ্রামে। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আলী। বাবা মায়ের দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে ওয়াজ উদ্দিন দ্বিতীয় ছেলে। ২০১০ সালে একই উপজেলার শেরপুর গ্রামের বীর মুক্তিযুদ্ধা সামসুল হকের মেয়ে শিউলি আক্তারকে সামাজিকভাবে বিয়ে করেন।
তাদের দাম্পত্য জীবনে ২ মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ে নুপুর আক্তারকে বিয়ে দেয়া হয়েছে, দ্বিতীয় মেয়ে সামিয়া আক্তার ইসলামপুর উচ্চ বিদ্যালয়য়ে ৭ম শ্রেণিতে পড়ে, তৃতীয় ছেলে নিহাদ ২ শ্রেনীতে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে এবং ছোট ছেলে জিহাদের বয়স মাত্র ৬ বছর।
উন্নত জীবনের আশায় ৬ লাখ টাকা ধার-দেনা করে পার্শ্ববর্তী বাঙালি নগরের নাসির নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে প্রায় ১০ থেকে ১১ মাস পূর্বে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সংসারের উন্নত জীবনের আশা নিমিষেই ভঙ্গ হয়ে গেল। হয়তো অর্ধেক ঋণও পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে নিভে গেল ওয়াজউদ্দিনের জীবন প্রদীপ।
মৃত ওয়াজউদ্দিনের বড় ভাই আজহার আলী জানান, ১০/১১ মাস পূর্বে প্রতিবেশী নাসির নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে এই এলাকার মুনসুর আলীর ছেলে আরিফ (২২), লোকমান মিয়ার ছেলে রাসেল (২০), লতিফ মিয়ার ছেলে রায়হান (১৯) এবং বড় ভাই ওয়াজ উদ্দিন মালয়েশিয়া যায়। ওখানে গিয়ে একই কোম্পানিতে চাকরি করে এবং একই রুমে বসবাস করে। গত ১ আগস্টের বিকেলে তিনি ছুরিকাঘাতে নিহত হন। ১৫ আগস্ট সকালে মরদেহ বাড়িতে আনা হয়। এই মরদেহ ১৬ আগস্ট পর্যন্ত নিজ বাড়ির উঠানেই ফ্রিজার ভ্যানে পড়েছিল। কারণ হিসেবে তিনি জানান, তাকে হত্যার বিষয়ে একই রুমে থাকা আরিফ, রাসেল ও রায়হানকে সন্দেহ হয়। তাই তাদের শাস্তি বা টাকা আদায়ের বিষয়ে মিমাংসা না করা পর্যন্ত দাফন কাজ হচ্ছে না।
এদিকে আরিফ, রাসেল ও রায়হানের পরিবারের পক্ষ থেকে আরিফের বাবা মুনসুর আলী জানান, আরিফ, রায়হান, রাসেল ও ওয়াজ উদ্দিন মালয়েশিয়া গিয়ে একই রুমে বসবাস করতো। পাশের একটি রুমে বসবাস করে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার বেলু মিয়ার ছেলে আলফাজ ও জয়নাল মিয়ার ছেলে আরফান। কোম্পানিতে ওয়াজ উদ্দিনের সুনাম থাকায় প্রতিবেশী রুমের আলফাজ ও আরফানের সঙ্গে ওয়াজ উদ্দিনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এরই জের ধরে ১ আগস্ট কিশোরগঞ্জের আলফাজের হাতে খুন হয় ওয়াজ উদ্দিন এবং মারাত্মকভাবে আহত হন আরিফ। খবর পেয়ে মালয়েশিয়া পুলিশ আরিফ ও আলফাজকে ধরে নিয়ে যায়। দীর্ঘ ১৪ দিন তদন্ত শেষে কিশোরগঞ্জের আলফাজকে দোষী প্রমাণিত করে আদালতে রিপোর্ট দাখিল করে। আদালত আলফাজকে ৩০ বছরের জেল দেয় এবং আরিফকে খালাস ঘোষণা করে। এ ঘটনায় ওয়াজ উদ্দিনের পরিবার ও আত্মীয় স্বজনরা আরিফ, রায়াহান ও রাসেলকে দোষারোপ করে আমাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য চাপ প্রয়োগসহ নানা রকম হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
গত শুক্রবার (১৬ আগস্ট) বেলা দশটার দিকে ওয়াজ উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, লাশবাহী একটি ফ্রিজার ভ্যান উঠানে দাঁড়ানো। তাতে রয়েছে মালয়শিয়া প্রবাসী ওয়াজ উদ্দিনের মরদেহ। বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) সকালেই মরদেহটি তাদের বাড়িতে আসে।
বৃহস্পতিবার বিকেলেই জানাজা শেষে দাফন করার কথা। কিন্তু ওয়াজ উদ্দিনের পরিবারের পক্ষ থেকে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ হিসেবে ওয়াজ উদ্দিনের হত্যার সঙ্গে আরিফ, রাসেল ও রায়হান জড়িত বলে সন্দেহ করেন ওয়াজ উদ্দিনের পরিবার। এজন্য হত্যাকারীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আদায়ের প্রস্তাব দেয়া হয়। এই প্রেক্ষিতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বশির উদ্দিন সরকার (রিপন) ও ইউপি সদস্য আলকাছ মিয়াসহ প্রায় দু শতাধিক মানুষের সমন্বয়ে এক সালিশ বসেছে ওয়াজ উদ্দিনের বাড়িতে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা গেছে, সালিশ দরবারে প্রাথমিকভাবে ওয়াজ উদ্দিনের হত্যার সঙ্গে রাসেল, আরিফ ও রায়হানকে সন্দেহজনক মনে করে দশ লাখ টাকা এবং আসামি প্রমাণিত হলে ২০ লাখ টাকা জরিমানা ধার্য করা হয় বলে জানা গেছে।
সবশেষে প্রায় দুই দিন পর মিমাংসা শেষে শুক্রবার (১৬ আগস্ট) বিকেলে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়।