দেশের প্রথম মোবাইল অপারেটর কোম্পানি সিটিসেল তাদের লাইসেন্স পুনর্বহালের জন্য সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে। ২০১৬ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে সিটিসেলের কার্যক্রম।
চিঠিতে কোম্পানিটি বলেছে, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষের নয় এমন একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সিটিসেল যুক্ত ছিল, এমন ‘অযৌক্তিক ধারণা’ থেকে লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে গত আট বছরে সিটিসেলের মূল কোম্পানি প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (পিবিটিএল) বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) পক্ষপাতদুষ্ট, অপ্রীতিকর ও অসৎ উদ্দেশ্যে নেওয়া সিদ্ধান্ত ও মূল্যায়নের শিকার হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, এ ছাড়া, বিটিআরসি তার ক্ষমতার অতিরিক্ত ও অপব্যবহার করে স্পষ্ট বৈষম্যমূলক উদ্যোগ নিয়েছে শুধুমাত্র এই অযৌক্তিক ধারণার ভিত্তিতে যে পিবিটিএল এমন একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যারা তৎকালীন সরকারের পক্ষে ছিল না।
বিটিসিএল বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল অপারেটর কোম্পানিটির স্পেকট্রাম বাতিল করায় ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে গ্রাহক সেবা দিয়ে আসা সিটিসেলের কার্যক্রম।
সময়মতো বকেয়া পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৬ সালের অক্টোবরে নিয়ন্ত্রক সংস্থার একটি প্রযুক্তি দল ঢাকার মহাখালীতে সিটিসেলের প্রধান কার্যালয়ে যায় এবং কোম্পানিটির নেটওয়ার্ক সুইচ বন্ধ করে দেয়।
তখন সিটিসেলের কাছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ৪৭৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা পাওনা ছিল বলে বিটিআরসি জানিয়েছে।
সিটিসেলকে চার সপ্তাহের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ বা ৩১৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।
সিটিসেল বলেছে, তাদের কার্যক্রম যেন বন্ধ করে দেওয়া না হয়, সেজন্য নিজেদের হিসাব অনুযায়ী বিটিআরসির পাওনার দুই-তৃতীয়াংশ ২৪৪ কোটি টাকা তারা পরিশোধ করেছে।
এ সময় বিটিআরসি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। স্পেকট্রাম স্থগিতাদেশ স্থায়ী। এটি ফিরে পাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই।’
পরবর্তীতে আপিল বিভাগের আদেশে সিটিসেলের স্পেকট্রাম ফিরিয়ে দেয় বিটিআরসি এবং রেডিও যোগাযোগের জন্য ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
কিন্তু কোম্পানিটি পুনরায় কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।
অপারেশন বন্ধের আগে ধীরে ধীরে গ্রাহক হারাচ্ছিল সিটিসেল। সিটিসেল কোড-ডিভিশন মাল্টিপল অ্যাক্সেস (সিডিএমএ) প্রযুক্তি ব্যবহার করতো। যদিও মোবাইল কমিউনিকেশনের জন্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল (জিএসএম)। ২০১০ সালে কোম্পানিটির প্রায় ৩০ লাখ গ্রাহক থাকলেও ২০১৬ সালে তা পাঁচ লাখ ৫৯ হাজারে নেমে আসে।
জিএসএম ও সিডিএমএর মধ্যে মূল পার্থক্য হলো, জিএসএম হ্যান্ডসেটগুলোতে সিম কার্ড স্লট থাকে আর সিডিএমএতে একটি হ্যান্ডসেটের জন্য একটি নির্দিষ্ট সিম কার্ড নম্বর নির্দিষ্ট করা থাকে। অনেকের কাছে এটি অসুবিধা মনে হয়, কারণ তারা চাইলেই সহজে তাদের হ্যান্ডসেটে অন্য সিম ব্যবহার করতে পারেন না।
বকেয়া পরিশোধ না করায় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সরকার সিটিসেলের ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ বাতিল করে। এরপর ২০২৩ সালের মার্চে কোম্পানির লাইসেন্সই বাতিল করে বিটিআরসি। তাদের দাবি, সিটিসেলের মূল প্রতিষ্ঠান পিবিটিএলের কাছে বিটিসিএলের পাওনা ২১৮ কোটি টাকা।
লাইসেন্স বাতিলের চিঠিতে বিটিআরসি বলেছে, পিবিটিএল বকেয়া পরিশোধ করতে এবং আপিল বিভাগের আদেশ ও রায় মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছে।
সিটিসেলের লাইসেন্স ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধের বিষয়ে টেলিকম নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করে দ্য ডেইলি স্টার। তবে বিটিআরসি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
পিবিটিএলের রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট বিভাগের প্রধান নিশাত আলি খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘লাইসেন্স বাতিল করার জন্য যে চিঠি দেওয়া হয়েছে সেখানে বিলম্ব ফিয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা মূল বকেয়ার পুরোটাই পরিশোধ করেছি।’
তিনি বলেন, ‘বিলম্ব ফি এবং চলমান বিল জমা হয়েছিল বরাদ্দকৃত স্পেকট্রাম থেকে, যেটা ব্যবহার করা হয়নি।’
বিটিআরসিকে দেওয়া চিঠিতে সিটিসেল দাবি করেছে, ‘বিটিআরসি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের কারণে কোম্পানিটি বন্ধ না হলে গত আট বছরে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আসতে পারতো পিবিটিএল থেকে।’
কোম্পানিটি সম্পূর্ণ ১০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রামসহ তার সেলুলার মোবাইল ফোন অপারেটর লাইসেন্স এবং রেডিও যোগাযোগ সরঞ্জাম লাইসেন্স পুনরায় পাওয়ার দাবি করেছে।
তারা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত টুজি, থ্রিজি, ফোরজি এবং ফাইভজি লাইসেন্স দেওয়ার অনুরোধ করেছে এবং লাইসেন্স ফি না দেওয়ার জন্য ‘বেআইনি ও স্বেচ্ছাচারী’ জরিমানা মওকুফ করার আহ্বান জানিয়েছে।
বিএনপির সাবেক সিনিয়র নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান পিবিটিএলের চেয়ারম্যান।